Missing titanic

টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া সাবমেরিনের যাত্রীদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে

আমি জানি না আপনারা কতজন এই খবরটি ফলো করছেন, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের মানুষ এই মুহুর্তে ইউক্রেন, বা প্যালেস্টাইন যুদ্ধ নিয়ে নয়, বরঞ্চ উদ্বিগ্ন হয়ে খেয়াল করছে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখতে আটলান্টিক মহাসমুদ্রের প্রায় ৪ কিলোমিটার নিচে নামা ছোট্ট একটা হারিয়ে যাওয়া সাবমেরিনের উদ্ধার চেষ্টার গতি-প্রকৃতি নিয়ে। ওশানগেট নামে একটি কোম্পানী ১৯৮৫ সালে আটলান্টিকের গভীরে চিহ্নিত হওয়া টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গবেষণা করে এবং গত কয়েক বছর ধরে অর্থের বিনিময়ে তাদের ছোট্ট একটি সাবমেরিনে করে ৪ জন পর্যন্ত পর্যটক নিয়ে আটলান্টিকের গভীরে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখাতে নিয়ে যায়।

প্রতি যাত্রীকে এই ৮ দিনের ভ্রমণের জন্য ব্যয় করতে হয় বাংলাদেশী মুদ্রায় ২ কোটি টাকার কিছু বেশী। এর মধ্যে পানির নিচের ভ্রমণ মাত্র ৮-১০ ঘন্টার মতো হলেও ক্যানাডার নিউ ফাউন্ডল্যান্ড প্রদেশের সেন্ট জন থেকে জাহাজে রওয়ানা দিয়ে আটলান্টিকের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে ফিরে আসার প্রস্তুতিসহ মোট ৮ দিন লেগে যায়।

প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ভ্রমণে যেতে পারে কেবল অত্যন্ত বিত্তবান মানুষরাই। টিকিট বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থের বড় অংশ এই কোম্পানীটি তাদের গবেষণা কাজে ব্যয় করে।
গত রোববার এই ছোট্ট সাবমেরিনটি ওশানগেটের মালিক ও ৪ জন পর্যটকসহ আটলান্টিকের গভীরে নামে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখবার জন্য।

প্রায় পৌনে দুই ঘন্টায় ২ কিলোমিটারের মতো গভীরে যাবার পর নিয়ন্ত্রক জাহাজের সাথে এর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিকেল ৫টা ১০ এ ফিরে আসার সময় পার হয়ে যাওয়ার পরে ওশানগেট কর্তৃপক্ষ, আমেরিকান নেভি এবং ক্যানাডিয়ান সামরিক বাহিনী উদ্ধার কাজ শুরু করে।

টাইটানিকের অবস্থান আটলান্টিকের প্রায় ৪ কিলোমিটার গভীরে যেখানে কোন আলো পৌঁছে না, কৃত্রিম আলো ছাড়া সেখানে কিচ্ছুটি দেখবার কোন উপায় নেই। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত আমেরিকা, ক্যানাডা তাদের সামরিক-বেসামরিক উদ্ধারকাজের মাধ্যমে ওই স্থানকে কেন্দ্র করে আটলান্টিকের উপরিভাগে প্রায় ১৯ হাজার স্কয়ার কিলোমিটার এলাকা খুঁজে দেখেছে যে সাবমেরিনটি কোথাও ভেসে উঠেছে কিনা। যদিও কিছু পাওয়া যায়নি।

মঙ্গলবার ক্যানাডার পি-৩ প্লেন আটলান্টিকের গভীরে টাইটানিকের কাছাকাছি একটি শব্দ শুনতে পায়। বিজ্ঞানীরা আগ্রহী হয় কারণ যে শব্দটি তারা পায় সেটি মূলত জোরে কিছুতে বাড়ি দেবার শব্দ, এবং শব্দটি ৩০ মিনিট পর পর আসতে থাকে। যদি এটি অন্য কোন শব্দ হতো তাহলে ৩০ মিনিট পর পর আসত না। এতে করে উদ্ধারকারীরা ভাবছেন এটি টাইটানের ভেতরের যাত্রীরাই করছেন, তারা ৩০ মিনিট পর পর করছেন যাতে তাদের অক্সিজেন ও শক্তি খরচ না হয়ে যায় এবং পানির উপরের উদ্ধারকারীরা বুঝতে পারেন এটি মানুষের করা শব্দ।
উল্লেখ্য টাইটানে যাত্রী ঢোকানোর পর উপর থেকে শক্ত বোল্ট দিয়ে আটকে দেয়া হয় যাতে করে এটিতে পানি ঢুকতে না পারে এবং পানির গভীরের প্রচন্ড প্রেসারে দুমড়ে মুচড়ে না যায়, এর অর্থ হচ্ছে সাবমেরিনটি নিজের থেকে পানির উপর ভেসে উঠলেও বাইরে থেকে কেউ না খুললে ভেতর থেকে মানুষের পক্ষে বের হওয়া সম্ভব না। এয়ার টাইট হবার কারণে সেই ক্ষেত্রে পানির উপর উঠলেও ভেতরের পর্যটকরা অক্সিজেনের অভাবে মারা যেতে পারেন। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় এই সাবমেরিনের ভেতরের অক্সিজেন শেষ হয়ে যাবে।

এছাড়া আটলান্টিকের ৪ কিলোমিটার নিচে পানির চাপ এত বেশী যে সময় মতো উদ্ধার না করতে পারলে ব্যাটারিচালিত সাবমেরিনটি একসময় দুমড়েমুচড়ে গুঁড়িয়ে যাবে ভেতরে থাকা পর্যটকসহ। সাবমেরিনটি ভেতর থেকে শুধুমাত্র ছোট একটা গেইম কন্ট্রোল প্যানেল দিয়ে চালানো হয়, মূল কন্ট্রোল পানির উপরে জাহাজে; যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সেটি এখন মূলত নিয়ন্ত্রনহীনভাবে পানির গভীরে কোথাও আটকে আছে। সাবমেরিনটির দৈর্ঘ্য দুটি হোনডা সি-আর-ভি গাড়ির সমান লম্বা মাত্র। এছাড়া পানির উপর থেকে তাদের অবস্থান চিহ্নিত করলেও ঘুটঘুটে অন্ধকারে ৪ কিলোমিটার নিচের এই সাবমেরিনটি চিহ্নিত করে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার মধ্যে উদ্ধার করার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। ধারণা করা হচ্ছে সাবমেরিনটি সম্ভবত টাইটানিক জাহাজেরই কোন ধ্বংসাবশেষে আটকে গেছে এবং ব্যাটারি শেষ হয়ে গিয়ে থাকলে ভেতরের যাত্রীরা হয়ত আগামীকাল কোন একসময় অক্সিজেনের অভাবে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে, প্রচন্ড শীতে ধুঁকতে ধুঁকতে মারা যাবেন।

আপনি এই লেখাটি যখন পড়ছেন, তখন আটলান্টিকের ৪ কিলোমিটার নিচে পৃথিবীর অন্যতম শীতল, গভীর ও অন্ধকারতম স্থানে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৪-৫ জন মানুষ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে সেখানেই আটকে পড়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। হয়ত ওশানগেটের মালিক ও টাইটানের চালক তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে, আদতে তাদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
মাটির উপর যে মানুষ হাজার কিলোমিটার জুড়ে রাজত্ব করছে, পানির নিচে মাত্র ৪ কিলোমিটার গভীরেই সেই মানুষ অসহায়, নিরুপায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *